স্মৃতির শহর মক্কা

0
370

ইসলাম ধর্মের পবিত্রতম নগরী মক্কা। এই শহরেই হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর জন্ম। পৃথিবীর প্রথম মসজিদ কাবা এখানেই অবস্থিত।  এই শহরের উপকন্ঠে জাবালে নূর পাহাড়ে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব কোরআন-এর প্রথম ওহি নাজিল হয়। ইসলমের বহু সমৃদ্ধ ইতিহাস ও হুজুর (সা:)-এর অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই শহরটি ঘিরে। রয়েছে নবী করীম (সা:) প্রতি আবু জাহেলের অত্যাচারের করুণ চিত্র। কোরাইশ বংশধরদের আভিজাত্যের কাহিনী। 
আমার নিজেরও অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে শহরটি ঘিরে। আজ থেকে ৪০ বছর আগে কিশোর বয়সে আমার মায়ের সাথে পরিবারের আরো ১১ সদস্যের সাথে সর্বকনিষ্ঠ আমি পবিত্র মক্কা নগরীতে হজ্ব করতে এসেছিলাম। আমার মায়ের হাত ধরেই ঘুরে বেড়িয়েছি এই শহরের পথে-ঘাটে। মা আজ  বেঁচে নেই। সেদিন হজ্ব করতে আসা পরিবারের ১১ সদস্যের ৯ জনই হারিয়ে গেছেন মহাকালের ডাকে। আমার প্রিয় নবীজির শহর, আমার স্মৃতির শহর মক্কায় আবার ফিরে আসার আনন্দে শিহরিত হচ্ছি বারবার। 
এবারে আমার ট্যুর ছিলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি দেশ নেদারল্যান্ডে। এর আগেও এদেশটি একবার ঘুরে এসেছি। কিন্তু সব দেখা হয়নি। তাই দ্বিতীয়বারের মতো এই দেশটিতে আমার পদার্পণ। রাজধানী আমটাস্টারডাম এবং ফুলের দেশ হিসেবে পরিচিত হল্যান্ড ভ্রমণ শেষে এবার আমার গন্তব্য পবিত্র মক্কা, মদিনা এবং তায়েফ। 
মাত্র গত মাসেই সৌদী সরকার তার দেশের অর্থনীতিকে সমুন্নত করতে এক যুগান্তকারী ঘোষণা দিয়েছে। প্রথমবারের মতো চালু করেছে ট্যুরিষ্ট ভিসা। ফলে যেকোন ধর্মের মানুষ দেশটি ভ্রমণের সুযোগ পাবেন। বিদেশী পর্যটকরা সেখানকার ইউনেস্কো ঘোষিত ৫টি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটও ঘুরে দেখার সুযোগ পাবেন। 
আমার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বাংলা ট্যুর যেহেতু বিশ্বের ৫টি মহাদেশে গাইডেড ট্যুর অপারেট করে, তাই সৌদী সরকারের এই ঘোষণায় আগ্রহান্বিত হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো এখানে আসা। তবে কাবা ঘর জিয়ারত, ওমরাহ পালন এবং নবীর (সা:) রওজায় সালাম পৌছানো অন্যতম আকর্ষণ ছিলো। পাশাপাশি মক্কা ও মদিনার বাইরেও অন্যান্য শহর দেখার প্রোগ্রামও আমার এবারের ভ্রমণে অন্তর্ভূক্ত ছিলো। 
সৌদী আরব ভ্রমণে এবার আমার বাহন ছিলো ইজিপ্ট এয়ার। নেদারল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডাম থেকে সোজা মিশরের রাজধানী কায়রো। তারপর ওখান থেকে জেদ্দা। মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকান মুসলিম দেশের অনেক এয়ারলাইন্সে ভ্রমণ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু কেনো জানি আমার কাছে ইজিপ্ট এয়ার-কেই অন্য এয়ারলাইন্সের চেয়ে ব্যতিক্রমী মনে হয়েছে। বিশেষ করে তাদের পরিশেষিত খাবারের স্বাদ আমার কাছে অনন্য মনে হয়। গেলোবার ইজিপ্ট এয়ারে ভ্রমণের সময় তাদের পরিবেশিত গরুর মাংসের স্বাদ আজো যেনো আমার জিভে লেগে আছে। 
কায়রো এয়ারপোর্টে নেমে তাদের ট্রানজিট লাউঞ্জে কতক্ষণ অপেক্ষা করলাম। বিমানের একজন কর্মকর্তা আমাদের সাথে নিয়ে অন্য একটি টার্মিনালে নিয়ে এলেন, যেখান থেকে জেদ্দার বিমান ছাড়বে। সেই টার্মিনালে গিয়ে হজ্ব বা ওমরাহ’র একটা আবহ পেলাম। কাবা শরিফ এবং রসুল (সা:) -এর রওজা মোবারকের ছবি দেয়ালে দেয়ালে। ওজু গোছল করে এহরাম পরার সুব্যবস্থা রয়েছে। 
কায়রো থেকে জেদ্দার দূরত্ব খুবই কম। মাত্র দু ঘন্টার ফ্লাইট। বিমান আকাশে উড্ডয়নের পরেই ডিনার পরিবেশন করলো। তারপর একে একে আসতে থাকলো কেক, কফি, চা। একেবারে বিমান জেদ্দা বন্দরে না নামা পর্যন্ত খাবার আসতেই লাগলো। একেবারে যেনো জামাই আদর। 
এয়ারপোর্টে আনুষ্ঠানিকতা সারতে বেশী বিলম্ব হলো না।  সম্ভবত আমেরিকান পার্সপোর্টও এর অন্যতম বড় কারণ। ইমেগ্রেশন পেরিয়ে ট্যাক্সি কাউন্টারে গেলাম। এরপোর্টের ভেতরে ট্যাক্সি কাউন্টার থেকে ট্যাক্সি নিতেই আমি সবসময় স্বাচ্ছন্দবোধ করি। তা যে দেশেই যাই না কেনো। কারণ গাড়ীতে কিছু রেখে গেলে বা ড্রাইভার কোন সমস্যা করলে কর্তৃপক্ষকে সহজেই খুঁজে বের করা যায়। 
কাউন্টারের কাছাকাছি ঢুকতেই বেশ কয়েকজন ঘিরে ধরলো। এদের থেকে একজনকে  বেছে নিয়ে আমার হোটেলের ঠিকানা দেখালাম। কাবাঘর সংলগ্ন হোটেল ‘লা মেরেডিয়ান’। ঠিকানা দেখে বললো ৯০ রিয়াল দিতে হবে। আমি দামাদামি না করে তাতেই রাজি হলাম। সৌদী ৯০ রিয়াল আমেরিকার ডলারে ২২ ডলারের মতো। আমস্টারডামে আমার হোটেল থেকে এয়ারপোর্টে আসতে ভাড়া দিতে হয়েছে ৭০ ইউরো। যা প্রায় ৭৮ ইউএস ডলারের সমমান। সেই হিসেবে জেদ্দা থেকে মক্কার ভাড়া এর চার ভাগের এক ভাগ। 
কাউন্টারের লোকটি আমাকে ট্যাক্সির কাছে এনে একজন ড্রাইভারের কাছে বুঝিয়ে দিলো। আরবীতে তাকে ঠিকানাও বলে দিলো। গাড়ী ছুটে চললো মক্কার দিকে। চুপচুপ এক মনে গাড়ী চালাচ্ছে ড্রাইভার। লম্বা জুব্বা আর টুপি মাথায় থাকলেও তাকে আমার ভারত উপমহাদেশের লোক বলে মনে হচ্ছিলো। ইরেজীতেই জিজ্ঞেস করলাম তার দেশ কোথায়? আমাকে অবাক করে দিয়ে বাংলায় জবাব দিলো বৃহত্তর কুমিল্লার ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় তার জন্মস্থান। সৌদীর মাটিতে পা রেখেই প্রথমে একজন বাংলাদেশীকে পেয়ে খুবই ভালো লাগলো। গল্প করতে করতে এগিয়ে চললাম। জানলাম, তিনি এর আগে মক্কার বাইরে ছোট একটি শহরের মসজিদে ইমামতি করতেন। এখন জেদ্দা এসে এই কোম্পানীর গাড়ী চালান। গল্পে গল্পে কখন যে সময় পেরিয়ে গেলো টের পাইনি। একসময় তিনি গাড়ী থামিয়ে বললেন- আমরা এসে গেছি। নেমে দেখলাম, বিশাল হোটেল। গেটে লা মেরেডিয়ান সাইন জ্বল জ্বল করছে। তার ভাড়া এবং টিপস মিটিয়ে দিয়ে বিদায় দিলাম। হোটেলের বেল বয় এসে লাগেজ উঠিয়ে নিয়ে গেলো।  
উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলাম রিসিপসনে। লম্বা জুব্বা, টুপি, রূমাল পরা একজন ইয়ংম্যান আমাকে স্বাগত জানালো। কিন্তু কম্পিউটারে তিনি আমার বুকিং খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অবশেষে আমার বুকিং রিসিট দেখতে চাইলেন। এতে আমি খুবই বিরক্ত হলাম। কারণ আমি সারা বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াই। আজ পর্যন্ত কেউই বুকিং রিসিট দেখতে চায়নি। সৌদী আরব বলেই সম্ভববত এটা প্রয়োজন। তবে বিরক্ত হলেও ব্যাগ খুলে রিসিটটা বের করে তার হাতে দিলাম। কপিটা হাতে নিয়েই তিনি এক গাল হেসে বললেন হোটেল ঠিক আছে, তবে এটা জেদ্দা লা মেরেডিয়ান। আমার বুকিং মক্কা লা মেরিডিয়ানে। যা এখান থেকে আরো ৯০ কিলোমিটার দূরে। 
তার কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পরলাম। নিমিষেই যেনো সারাদিনের ক্লান্তি এস ভর করলো শরীরে। রিসিপসনিষ্ট জানালেন সম্ভবত ইচ্ছে করেই ড্রাইভার আমাকে এখানে নামিয়ে দিয়েছে। কারণ ঠিকানা দেখার পর তার এমন ভুল হওয়ার কথা নয়। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো একজন দেশী ভাই মধ্যরাতে আমাকে মরুভূমির একটি অচেনা জায়গায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে। তার ফোন নম্বরও আমি রাখিনি যে কল দেবো। তবে আমার সাথে মানি রিসিট ছিলো। ওটা হোটেলের রিসিপসনিষ্টকে দিয়ে অনুরোধ জানালাম এয়ারপোর্টে ট্যাক্সি কাউন্টারে কল দিতে। ওনি ফোন দেওয়ার সাথে সাথেই একজন ফোন ধরলো। ড্রাইভার আমাকে নামিয়ে দিয়ে গিয়ে তখনো রিপোর্ট করেনি। কাউন্টার থেকে জানালো তারা ট্যাক্সি একটা পাঠাতে পারেন তবে মক্কায় আমার হোটেলের ঠিকানায় পৌছে দিতে আরো ২০০ রিয়াল পরিশোধ করতে হবে। আমার ভুলটা কোথায় বুঝতে পরছিলাম না। আমি তো তাদের মুখে কিছু বলিনি। আমার বুকিং রিসিট দেখিয়েছিলাম। তারপরও আমারকে কেনো মাঝপথে নামিয়ে দিলো আমারই বাংলাদেশী ভাই!
সারা বছর আমি দেশে দেশে ঘুরে বেড়াই। এধরনের সমস্যা মোকাবেলা করার অভ্যাস আমার রয়েছে। তাই আবার অনুরোধ করে বললাম তাদের একটা ফোন করে জানাতে যে আমি ফিরে আসছি জেদ্দায়, তবে একা নয়, সৌদি পুলিশ নিয়ে। তারাই সিদ্ধান্ত নেবে কে সঠিক বা কে বেঠিক। 
এবারের কলে যেনো মন্ত্রের মতো কাজ হলো। কাউন্টার থেকে জানালো আমাকে আসতে হবে না, তারা গাড়ী পাঠাচ্ছে। সে গাড়ী আমাকে মক্কা হোটেলে পৌছে দিলাম। আমি তখন তাদের জানাতে বললাম, তারা যেনো সেই একই ড্রাইভারকে পাঠায় যে আমাকে এখানে নামিয়ে দিয়েছিলো। তারা তাতেই রাজী হলো। 
আমি এবার স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললাম। বসলাম সোফাতে। রিসিপশন ম্যানেজার আমার জন্য খাবারের অর্ডার দিলেন। সাথে সাথেই হুকুম তামিল হলো। ওয়েটার নানা ধরনের খাবার নিয়ে এলো। আরবীয়রা যে অতিথিপরায়ণ নতুন করে তার প্রমাণ পেলাম। 
একটু পরেই গাড়ী এসে পৌছালো। কিন্তু হোটেল ম্যানেজার অনুরোধ জানালো রাতটা এখানেই কাটাতে। সকালে তিনি নিজেই ড্রাইভ করে মক্কায় আমার হোটেলে পৌছে দেবেন। আমি তার বদান্যতারজন্য ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। 
রাগে আমার শরীর রি রি করছিলো। ড্রাইভারকে বললাম, ভাই এই মাঝরাতে একটা অচেনা-অজানা জায়গায় নামিয়ে দিতে একটুও খারাপ লাগেনি? আপনি তো দীর্ঘদিন সৌদি আরবে আছেন। আমি ওমরাহ করতে এসেছি। ৯০ মাইল দূরে থেকে কিভাবে প্রতিদিন আমি কাবাঘর জিয়ারতে যবো- এই প্রশ্নটি কি একবারো মনে উঁকি দেয়নি? আমতা আমতা করে তিনি কি যেনো বলতে চাচ্ছিলেন। তাক বললাম- কোন কথা নয় সোজা মক্কায় আমার হোটেলের দিকে গাড়ী চালান। তাকে আরো বললাম। আমি ইচ্ছে করলেই আপনার ক্ষতি করতে পারতাম। পুলিশে রিপোর্ট করলে প্রথমেই আপনি গ্রেফতার হতেন। দেশী ভাই হিসেবে আমি তা করিনি। কিন্তু আপনি দেশী ভাইয়ের মর্যাদা রক্ষা করেননি। 
তার সাথে আর কোন কথা না বলে চুপচাপ গাড়ীর সীটে শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। ক্লান্তিতে কখন যে চোখ বন্ধ হয়ে গেছে টের পাইনি। তার ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম। বললো আমরা হোটেলে এসে গেছি। 
এবার আর আমি ঠকতে রাজি নই। গাড়ী থেকে বেড়িয়ে তাকে বললাম কোথাও যেনো না যায়। আমি ভিতরে খোঁজ নিয়ে আসি। যদি এবারও ভুল জায়গায় নিয়ে আসে তাহলে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমা করবো না। আমি রিসিপশনে গিয়ে রুমের চাবি নিলাম। বেল বয় লাগেজ নিয়ে উপরে গেলে আমি ফিরে এসে দেখলাম আমার দেশী ভাই অবনত মস্তকে অপেক্ষা করছে। আমি তাকে শুধু যেতে বললাম। কোন কথা না বলে তিনি রওনা হলেন জেদ্দার দিকে।

Search
Categories
Read More
Travel
স্মৃতির শহর মক্কা
ইসলাম ধর্মের পবিত্রতম নগরী মক্কা। এই শহরেই হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর জন্ম। পৃথিবীর প্রথম মসজিদ কাবা...
By সামিউল ইসলাম 2025-02-24 15:57:05 0 370